ADV

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ: ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তীকালীন শাসন এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ


বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ: ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তীকালীন শাসন এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তীকালীন শাসন এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

ভূমিকা: একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার পতন

২০২৪ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই বছরটি শুধুমাত্র একটি সরকারের পতন প্রত্যক্ষ করেনি, বরং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং এর স্থায়িত্বের ভিত্তি নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। জুলাই মাসের ছাত্র আন্দোলন, যা পরবর্তীকালে এক গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়, তা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল বছরের পর বছর ধরে পুঞ্জীভূত রাজনৈতিক মেরুকরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়, এবং ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তোষের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি1। এই প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য হলো, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল এক সন্ধিক্ষণ যা 'উন্নয়নের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদ' (development-authoritarianism) মডেলের ওপর নির্মিত রাজনৈতিক কাঠামোর ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করেছে। এই ঘটনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য একটি অনিশ্চিত কিন্তু রূপান্তরকামী সুযোগ তৈরি করেছে।

এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। প্রথমে, আমরা সংকট-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ২০২৪ সালের জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনব্যবস্থার স্বরূপ বিশ্লেষণ করব। দ্বিতীয়ত, কোটা সংস্কার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ থেকে গণঅভ্যুত্থানের দাবানলে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ব্যবচ্ছেদ করা হবে, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা বিশেষভাবে আলোচিত হবে। তৃতীয়ত, পট পরিবর্তনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো, তার সামনে থাকা চ্যালেঞ্জসমূহ এবং এর ফলে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক অভিঘাত ও জনমতের প্রতিফলন তুলে ধরা হবে। চতুর্থ অধ্যায়ে, এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তরুণ প্রজন্মের অভূতপূর্ব জাগরণ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন ধারাকে বিশ্লেষণ করা হবে। সবশেষে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা, এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে একটি উপসংহার টানা হবে। এই বিশদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করাই এই প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য।

 

প্রথম অধ্যায়: সংকট-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক আবহাওয়া - ভাঙনের সুর

 

১.১ জানুয়ারি ২০২৪-এর নির্বাচন: একটি প্রশ্নবিদ্ধ ম্যান্ডেট

২০২৪ সালের রাজনৈতিক সংকটের তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এই নির্বাচনটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখলেও এর বৈধতা নিয়ে দেশ ও বিদেশে মারাত্মক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, যা পরবর্তী গণঅসন্তোষের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়া ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২২৪টি আসনে জয়লাভ করে 3। তবে এই বিজয় ছিল মূলত একতরফা, কারণ দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপির প্রধান দাবি ছিল একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান, যে ব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল করে দিয়েছিল 4। বিএনপির এই বর্জনের ফলে নির্বাচনটি তার প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চরিত্র হারায়। এই শূন্যতা পূরণের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব অনেক নেতাকে "স্বতন্ত্র" প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড় করায়, যারা ৬২টি আসনে জয়ী হন 4। এই কৌশলটি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর একটি প্রচেষ্টা হলেও এটি মূলত একটি সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করে, যা ভোটারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।

নির্বাচনের বৈধতাকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে ভোটার উপস্থিতির হার। নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ৪১.৮% ভোটার উপস্থিতির কথা বললেও, এই সংখ্যাটি ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজে প্রাথমিকভাবে ২৮%-এর মতো উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা পরে সংশোধন করা হয় 4। এই স্বল্প উপস্থিতি শুধুমাত্র বিরোধী দলের বর্জনকেই প্রতিফলিত করে না, বরং সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থারও পরিচায়ক ছিল।

এই নির্বাচনের ফলাফল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনকে "অবাধ ও সুষ্ঠু নয়" বলে অভিহিত করে এবং যুক্তরাজ্য মন্তব্য করে যে, এই নির্বাচনে "গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত অনুপস্থিত" ছিল 4। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও সংস্থাগুলোর এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শেখ হাসিনা সরকারকে গণতান্ত্রিক বৈধতার সংকটে ফেলে দেয় এবং বিশ্বমঞ্চে তাকে ক্রমশ একঘরে করে তোলে।

এই নির্বাচনটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি কৌশলগত বিজয় হলেও চূড়ান্তভাবে এটি একটি রাজনৈতিক পরাজয় ছিল, যা সরকারের পতনের পথকে প্রশস্ত করে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যা বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস জন্ম দেয় এবং ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে 8। ২০২৪ সালে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হলেও, এটি তার গণভিত্তি এবং রাজনৈতিক বৈধতা মারাত্মকভাবে ক্ষয় করে ফেলে। যখন কয়েকমাস পরেই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, তখন সরকারের পেছনে কোনো শক্তিশালী জনসমর্থন বা গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট ছিল না। সরকারের কর্তৃত্ব তখন কেবল রাষ্ট্রীয় দমনযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা একটি প্রকৃত গণআন্দোলনের মুখে অত্যন্ত ভঙ্গুর বলে প্রমাণিত হয় 1। সুতরাং, জানুয়ারির নির্বাচনটি সরকারের শক্তির প্রদর্শন ছিল না, বরং এটি ছিল তার দুর্বলতার এক মারাত্মক প্রকাশ, যা পরবর্তীকালে তার পতনকে অনিবার্য করে তোলে। এর পাশাপাশি, বছরের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনগুলোও দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই সম্পন্ন হয় 10

 

১.২ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন: উন্নয়ন ও কর্তৃত্ববাদের দ্বৈততা

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় দেড় দশকের শাসনকালের মূল ভিত্তি ছিল উন্নয়ন ও কর্তৃত্ববাদের এক জটিল সংমিশ্রণ। সরকারের বৈধতার প্রধান বয়ানটি দাঁড়িয়েছিল দৃশ্যমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের ওপর 9। "ভিশন ২০২১", "ডিজিটাল বাংলাদেশ" এবং শতবর্ষী "ডেল্টা প্ল্যান-২১০০"-এর মতো উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল 6। এই সময়ে মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সাফল্য অর্জিত হয় 15

তবে এই উন্নয়নের আড়ালে ছিল গণতান্ত্রিক পরিসরের এক পদ্ধতিগত সংকোচন। সরকার ক্রমশ রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যার মধ্যে ছিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনী 8। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (যা পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়) মতো দমনমূলক আইন ব্যবহার করে ভিন্নমতকে স্তব্ধ করার এক ব্যাপক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই আইনের আওতায় হাজার হাজার সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাধারণ সমালোচককে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হয় 14। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, যার মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা 14

২০২৪ সাল নাগাদ সরকারের এই 'উন্নয়নের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদ' মডেলটি তার কার্যকারিতা হারাতে শুরু করে। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০%-এ পৌঁছে যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে, এবং আয়বৈষম্য ও তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়তে থাকে 1। ফলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যখন আকাশচুম্বী, তখন সরকারের উন্নয়নের বয়ানটি তাদের কাছে অন্তঃসারশূন্য মনে হতে শুরু করে।

এই অর্থনৈতিক সংকট সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি জনগণের সহনশীলতা কমিয়ে দেয়। যে কর্তৃত্ববাদকে একসময় অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একটি প্রয়োজনীয় মন্দ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল, অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার সাথে সাথে সেটিই গণঅসন্তোষের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে, যারা একটি প্রতিকূল চাকরির বাজারের মুখোমুখি হচ্ছিল 15, ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। ঠিক এই সময়েই যখন হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেয়, তখন এটি শুধুমাত্র একটি অন্যায় নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়নি, বরং এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত হয়, যা মেধার পরিবর্তে আনুগত্যকে পুরস্কৃত করে এবং সাধারণ মানুষের জন্য সীমিত সুযোগগুলোও বন্ধ করে দেয় 1। এভাবেই অর্থনৈতিক সংকট গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো বিমূর্ত উদ্বেগগুলোকে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব অভিযোগে রূপান্তরিত করে, যা একটি গণআন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করে। সরকারের শাসনের প্রধান যুক্তিটিই তখন ভেঙে পড়ে।

 

১.৩ বিরোধী দলের অবস্থান ও কৌশল

বাংলাদেশের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মেরুকরণ দ্বারা সংজ্ঞায়িত 8। ২০২৪ সালের সংকটের প্রাক্কালে, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি একটি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে ছিল। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কারাবাস এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্বাসনের কারণে দলটি কার্যকর নেতৃত্বের সংকটে ভুগছিল 5। বিএনপির মূল রাজনৈতিক কৌশল ছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা 4

জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী দলগুলোর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়। বিএনপির প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পুরোনো মামলা সচল করে দ্রুত রায় দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় 8। এই ব্যাপক ধরপাকড়ের ফলে দলটি সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

জুলাই মাসে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, তখন এটি ছিল মূলত একটি অরাজনৈতিক, ছাত্রকেন্দ্রিক আন্দোলন। তবে আন্দোলনটি যখন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মুখে পড়ে এবং সরকারবিরোধী রূপ ধারণ করে, তখন বিএনপির নেতাকর্মীরা ও সমর্থকরা এতে যোগদান করে 25। যদিও বিএনপি এই আন্দোলনকে সরাসরি নেতৃত্ব দেয়নি, তবে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান দলটির দীর্ঘদিনের লক্ষ্য—আওয়ামী লীগ সরকারের পতন—পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে 26। কার্যত, ছাত্ররা যে গণবিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তার রাজনৈতিক সুফলভোগী হিসেবে বিএনপি আবির্ভূত হয়, যা দলটিকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় দেড় দশক পর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসার সুযোগ করে দেয়।

 

দ্বিতীয় অধ্যায়: স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল - জুলাই বিপ্লবের ব্যবচ্ছেদ

 

২.১ কোটা সংস্কার থেকে গণঅভ্যুত্থান

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল একটি আপাতদৃষ্টিতে নির্দিষ্ট ও সীমিত দাবি নিয়ে, কিন্তু তা দ্রুতই এক সর্বাত্মক সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত জনঅসন্তোষ।

আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গটি জ্বলে ওঠে ২০২৪ সালের জুন মাসের শুরুতে, যখন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য ৩০% কোটা পুনর্বহালের রায় দেয়। ২০১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার এই কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেছিল 22। উচ্চ বেকারত্বের দেশে, যেখানে তরুণরা চাকরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন 15, এই রায়কে মেধার পরিবর্তে বংশীয় সুযোগ-সুবিধাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'-এর ব্যানারে একত্রিত হয়। তাদের প্রাথমিক দাবিগুলো ছিল অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট: বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সর্বোচ্চ ৫% কোটার একটি নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা 28

কিন্তু যখনই এই আন্দোলন রাজপথে দানা বাঁধতে শুরু করে, তখনই এটি সরকারের সহিংস প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এই সহিংসতার ফলে যখন ছাত্র হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে, যা পরবর্তীতে "জুলাই গণহত্যা" হিসেবে পরিচিতি পায়, তখন আন্দোলনের চরিত্র ও দাবি উভয়ই আমূল বদলে যায়। আন্দোলনটি আর কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি একটি গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ছাত্রদের নতুন দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিচার, এবং আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল)-কে নিষিদ্ধ করা 28

আন্দোলনকারীরা এই পর্যায়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, দেশব্যাপী সড়ক ও রেলপথ অবরোধের মতো 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচি, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তারা জনমতকে সংগঠিত করে 26। চূড়ান্ত পর্যায়ে, তাদের 'অসহযোগ আন্দোলন'-এর ডাকে সাড়া দিয়ে সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে, যা সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।

 

২.২ রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ও সহিংসতার বিস্তার

আন্দোলনের প্রতি সরকারের প্রতিক্রিয়া শুরু থেকেই ছিল দমনমূলক এবং সহিংস, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এবং চূড়ান্তভাবে সরকারের নিজেরই পতন ডেকে আনে। একটি বৈধতার সংকটকে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করার ভুলটিই সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম থেকেই, আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল) সহিংস আক্রমণ চালায়, এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের সহায়তা করতে বা নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায় 22। সরকারের এই কৌশল ছিল ভিন্নমত দমনের একটি পরিচিত ছক, যা অতীতেও বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে 14

কিন্তু জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই সহিংসতা এক নতুন ও ভয়াবহ মাত্রা লাভ করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলন দমনে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি গুলি ব্যবহার করে। এই নৃশংস দমনে শত শত ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নিহত হয় (আনুমানিক সংখ্যা ৩০০ থেকে ৮০০-এর বেশি) এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয় 22। এই ঘটনা "জুলাই গণহত্যা" নামে পরিচিতি পায় এবং এটি দেশবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া এবং দেশব্যাপী কারফিউ জারির মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেও সরকার এই গণরোষকে থামাতে পারেনি 22

রাষ্ট্রের এই দমনমূলক সহিংসতা একটি সীমিত ছাত্র আন্দোলনকে একটি সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। কোটা সংস্কারের নির্দিষ্ট দাবিটি তখন গৌণ হয়ে যায়; মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় একটি নিপীড়ক ও অবৈধ সরকারের অপসারণ। "জুলাই গণহত্যা" সরকারের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রকে নগ্নভাবে উন্মোচিত করে এবং আন্দোলনকারীদের এই বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এই নৈতিক সংহতি সাধারণ জনগণ, বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজকে একত্রিত করে, যা ছাত্র আন্দোলনকে একটি "গণঅভ্যুত্থান"-এ পরিণত করে 1। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী ম্যান্ডেটের কারণে সরকারের যে নৈতিক দুর্বলতা ছিল, তা এই গণরোষের সামনে দাঁড়াতে পারেনি।

 

২.৩ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে গণমাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, একটি নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। এটি একদিকে যেমন আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি প্রচলিত গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতাকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টিকটক, এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল। বিশেষ করে আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো সরকারের চাপে সংবাদের ওপর স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ (self-censorship) আরোপ করেছিল, তখন এই প্ল্যাটফর্মগুলোই ছিল তথ্য প্রচার, প্রতিবাদ সংগঠিত করা এবং রাষ্ট্রীয় বয়ানের বিকল্প তুলে ধরার প্রধান মাধ্যম 27। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জি, এই মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেশব্যাপী আন্দোলনকে সমন্বয় করেছে এবং জনমত গঠনে সহায়তা করেছে।

এর বিপরীতে, বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম একটি জটিল ও পরাধীন অবস্থায় ছিল। অধিকাংশ বড় বড় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা ছিল সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে, যারা তাদের গণমাধ্যমকে সাংবাদিকতার পরিবর্তে নিজেদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত 19। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক আইনের কারণে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, যার ফলে অনেক গণমাধ্যমই আন্দোলন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল বা সরকারের ভাষ্যই প্রচার করছিল।

শেখ হাসিনার পতনের পর গণমাধ্যম একটি নতুন কিন্তু অনিশ্চিত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সরাসরি হুমকি দূরীভূত হলেও, স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এবং মালিকানার আপোসকারী কাঠামো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে 19। এই গভীর কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি 'গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন' গঠন করেছে, যা একটি স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে 29

 

তৃতীয় অধ্যায়: পট পরিবর্তন - নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

 

৩.১ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: গঠন ও লক্ষ্য

৫ আগস্ট ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর বাংলাদেশ একটি নজিরবিহীন সাংবিধানিক সংকটের মুখোমুখি হয়। দেশের সংবিধানে এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কোনো সুস্পষ্ট বিধান ছিল না 31। এই শূন্যতা পূরণের জন্য, ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করে 23

এই সরকারের গঠন কাঠামোটি ছিল অনন্য। এতে tecnocrat, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং মানবাধিকার কর্মীদের পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতাদেরও উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় 23। নাহিদ ইসলামের মতো ছাত্র নেতার সরাসরি সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা, যা এই পরিবর্তনের গণচরিত্রকে প্রতিফলিত করে 32

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন: নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন) ব্যাপক সংস্কার সাধন, একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করা, এবং সবশেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা 9। নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক থাকলেও, সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছে 20। এই সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ হলো একটি স্বল্প সময়ের মধ্যে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা এবং একই সাথে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে গণতান্ত্রিক উত্তরণকে মসৃণ করা।

 

৩.২ সামাজিক-অর্থনৈতিক অভিঘাত

২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর গভীর এবং বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলেছে। এই অভিঘাতগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এবং দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথকে প্রভাবিত করছে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক সংকট আগে থেকে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরও ঘনীভূত করেছে। মাসব্যাপী আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয় 15। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে, যার মধ্যে ছিল লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, কমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং একটি লুণ্ঠিত ব্যাংকিং খাত 20। জনমত জরিপগুলোতে দেখা যায় যে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং অর্থনৈতিক মন্দা এখনো সাধারণ মানুষের প্রধান উদ্বেগের কারণ 35

শিক্ষা খাত এই রাজনৈতিক পালাবদলে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলার শিকার হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সকল উপাচার্য, যাদের অধিকাংশই পূর্ববর্তী সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন, পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয় 38। নতুন উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া, স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে হঠাৎ করে পুরোনো কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এবং এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের মতো পদক্ষেপগুলো শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি (learning loss) মারাত্মক আকার ধারণ করেছে 38। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা খাতের মতো একটি মৌলিক খাতকে সংস্কারের ক্ষেত্রে অবহেলা করার অভিযোগ উঠেছে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরি করছে।

 

৩.৩ জনমতের প্রতিফলন

গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জনমতে একটি নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যা বিভিন্ন জরিপে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই পরিবর্তনটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রাথমিক উচ্ছ্বাস এবং পরবর্তীকালে ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যকার ব্যবধানকে তুলে ধরে।

অভ্যুত্থানের পরপরই দেশে এক ব্যাপক আশাবাদের সঞ্চার হয়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের আগস্ট ২০২৪-এর যৌথ জরিপে দেখা যায়, ৭১% মানুষ মনে করেছিল যে দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে, যা ছিল জানুয়ারির (৪৩%) তুলনায় এক বিশাল উল্লম্ফন 35। এই প্রাথমিক উচ্ছ্বাস মূলত নতুন সরকারের প্রতি মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল। ৮৩% মানুষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপকে সমর্থন করে এবং ৮১% মানুষ মনে করে যে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত 35

তবে, সরকারের 'মধুচন্দ্রিমা' পর্বটি ছিল স্বল্পস্থায়ী। সময়ের সাথে সাথে এই প্রাথমিক আশাবাদ কমতে থাকে। অক্টোবর ২০২৪-এ পরিচালিত জরিপগুলোতে দেখা যায় যে, 'দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে'—এই ধারণার প্রতি সমর্থন কমতে শুরু করেছে এবং অর্থনৈতিক উদ্বেগ পুনরায় জনমনে প্রধান্য বিস্তার করছে 35। ভয়েস অফ আমেরিকা (VOA)-এর একটি জরিপে দেখা যায়, যদিও ৬৫.৯% মানুষ সরকারের ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমকে সমর্থন করে, ৬১.১% মানুষ এক বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছে 36। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে থাকা মূল দ্বিধাটিকে স্পষ্ট করে: একদিকে গভীর ও সময়সাপেক্ষ সংস্কারের জনসমর্থন, এবং অন্যদিকে দ্রুত নির্বাচিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য জনগণের অধীর অপেক্ষা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জনপ্রিয়তা এখনো তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও (৫৮.৪% মনে করে তারা পূর্ববর্তী সরকারের চেয়ে ভালো কাজ করছে), মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কম 36। এই জরিপগুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কার কার্যক্রম এবং জনজীবনের আশু সমস্যা সমাধানের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে, অন্যথায় তাদের অর্জিত গণসমর্থন ক্ষয়িষ্ণু হতে পারে।

সারণী ১: প্রধান রাজনৈতিক বিষয়ে জনমতের পরিবর্তন (অভ্যুত্থান-পরবর্তী)

 

সূচক

বিআইজিডি (আগস্ট '২৪) 35

ভিওএ (অক্টোবর '২৪) 36

বিআইজিডি (অক্টোবর '২৪) 35

বিআইজিডি (জুলাই '২৫) 35

দেশ সঠিক রাজনৈতিক পথে এগোচ্ছে?

৭১% হ্যাঁ

প্রযোজ্য নয়

৫৬% হ্যাঁ

৪২% হ্যাঁ

দেশ সঠিক অর্থনৈতিক পথে এগোচ্ছে?

৬০% হ্যাঁ

প্রযোজ্য নয়

৪৩% হ্যাঁ

৪৫% হ্যাঁ

জনগণের প্রধান উদ্বেগ

অর্থনৈতিক সমস্যা (৪০%)

অর্থনৈতিক সমস্যা

অর্থনৈতিক সমস্যা (৬৭%)

নির্বাচিত সরকারের অভাব (১৮%)

এক বছরের মধ্যে নির্বাচন সমর্থন

প্রযোজ্য নয়

৬১.১% হ্যাঁ

প্রযোজ্য নয়

প্রযোজ্য নয়

নির্বাচনের পূর্বে ব্যাপক সংস্কার সমর্থন

৮১% (যথেষ্ট সময় প্রয়োজন)

৬৫.৯% হ্যাঁ

প্রযোজ্য নয়

৫১% (সংস্কারের পর নির্বাচন)

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরম্যান্স রেটিং

৭৫% (অনুমোদন)

৫৮.৪% (পূর্বের চেয়ে ভালো)

৬৮.১৩% (অনুমোদন)

৬৩% (অনুমোদন)

এই সারণীটি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, সময়ের সাথে সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কমেছে এবং জনগণের অগ্রাধিকারের মধ্যে একটি পরিবর্তন এসেছে, যেখানে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিটি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।

 

চতুর্থ অধ্যায়: তরুণ প্রজন্মের জাগরণ - রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন সংজ্ঞা

৪.১ নব্যধারার ছাত্র আন্দোলন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিটি ক্রান্তিকালে ছাত্র ও তরুণ সমাজ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল নির্ধারক 21। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব এই ঐতিহাসিক ধারারই একটি নবতর ও শক্তিশালী সংস্করণ।

তবে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনটির কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল যা এটিকে পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলো থেকে পৃথক করে। প্রথমত, এই আন্দোলনের সংগঠন ও বিস্তারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার ছিল অভূতপূর্ব। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তরুণরা বিকেন্দ্রীভূত উপায়ে দেশব্যাপী আন্দোলনকে সমন্বয় করেছে 27। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল একটি অরাজনৈতিক ও সুনির্দিষ্ট দাবি (কোটা সংস্কার) নিয়ে, যা এটিকে একটি ব্যাপক ছাত্র ও তরুণ সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় এটি যখন সরকারবিরোধী রূপ নেয়, তখন এর পেছনে একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়। তৃতীয়ত, এই আন্দোলন সফলভাবে কোটার মতো একটি নির্দিষ্ট ইস্যুকে দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পেরেছিল। এর ফলে এটি শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি শ্রেণি-নির্বিশেষে গণআন্দোলনে পরিণত হয় 32

এই আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক দিকটি হলো এর পরিণতি। প্রথমবারের মতো, আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের সরাসরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে 23। এটি শুধুমাত্র তাদের নেতৃত্বের স্বীকৃতিই নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় তরুণদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।

 

৪.২ প্রথাগত রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা

তরুণরা রাজপথের আন্দোলনে কার্যকর শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করলেও, বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামোতে তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। এই ব্যবস্থার মধ্যে এমন কিছু গভীর প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা তরুণদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

এর মধ্যে প্রধান বাধাগুলো হলো—প্রবীণ-শাসিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে আনুগত্যকে মেধার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়; রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব, যা সাধারণ পরিবারের তরুণদের জন্য অংশগ্রহণকে কঠিন করে তোলে; এবং ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সহিংসতা ও দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা, যা অনেক মেধাবী তরুণকে এই ক্ষেত্র থেকে বিমুখ করে 21। এছাড়া, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তরুণদের মধ্যে এক ধরনের গভীর অনাস্থা ও উদাসীনতা রয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তারা প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিবর্তনের বাহক হিসেবে বিশ্বাস করতে পারে না 21

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও তরুণদের মধ্যে নাগরিক চেতনা ও নেতৃত্ব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। পাঠ্যক্রমে সুশাসন, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর না দেওয়ায় তরুণরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় না 40

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি বৈপরীত্ব তৈরি করেছে। এটি একদিকে যেমন প্রথাগত কাঠামোর বাইরে তরুণদের রাজনৈতিক কার্যকারিতার এক শক্তিশালী উদাহরণ স্থাপন করেছে, তেমনি কাঠামোর ভেতরের প্রতিবন্ধকতাগুলোকেও প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ছাত্রনেতাদের অন্তর্ভুক্তি এই দুইয়ের মধ্যে একটি সেতুবন্ধনের প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টাটি একটি উচ্চ ঝুঁকির পরীক্ষা। যদি ছাত্রনেতারা সফল হন, তবে তা দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রথাগত রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে। কিন্তু যদি তারা ব্যর্থ হন বা ব্যবস্থার অংশ হয়ে যান বলে প্রতীয়মান হয়, তবে এটি তরুণদের মধ্যে হতাশা আরও গভীর করতে পারে এবং এই বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে পারে যে, প্রকৃত পরিবর্তন শুধুমাত্র রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব, যা ভবিষ্যতে আরও অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে 33

পঞ্চম অধ্যায়: ভবিষ্যতের রূপরেখা - গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

 

৫.১ নির্বাচনের পথে যাত্রা

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের ভবিষ্যৎ পথটি সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যকার এক জটিল ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা, যা দেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। তবে এই যাত্রাপথটি মসৃণ নয়।

মূল বিতর্কটি আবর্তিত হচ্ছে সংস্কারের গভীরতা এবং নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে। একদিকে, দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, এবং প্রশাসন, বিগত বছরগুলোতে এতটাই রাজনৈতিকীকরণের শিকার হয়েছে যে, ব্যাপক সংস্কার ছাড়া একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন প্রায় অসম্ভব 9। এই সংস্কারগুলো সময়সাপেক্ষ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করেছে, যার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে জর্জরিত করা 'শূন্য-সমষ্টি' (zero-sum) এবং 'বিজয়ীর-সব-কিছু-নেওয়া' (winner-take-all) সংস্কৃতি থেকে বের করে আনা 8

অন্যদিকে, দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান চাপ রয়েছে। জনমত জরিপগুলো দেখাচ্ছে যে, জনগণ সংস্কার চাইলেও তারা একটি অনির্বাচিত সরকারের দীর্ঘমেয়াদী শাসন চায় না 36। নির্বাচন খুব তাড়াতাড়ি আয়োজন করা হলে পুরোনো রাজনৈতিক এলিটদেরই আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার ঝুঁকি থাকে, যা সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আবার, নির্বাচন আয়োজনে খুব বেশি দেরি করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা হ্রাস পেতে পারে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পুনরায় দেখা দিতে পারে 9। এই উভয় সংকটের মধ্যে একটি সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করাই হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

 

৫.২ গভীর প্রোথিত সংকট

গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু গভীর ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যা শুধুমাত্র একটি নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়।

প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার দীর্ঘদিনের শত্রুতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি প্রতিহিংসার চক্রে আবদ্ধ করে রেখেছে 8। গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও, দলটির একটি বিশাল জনভিত্তি রয়েছে। দলটিকে নিষিদ্ধ করার বা রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা একটি বড় জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্বহীন করে তুলবে এবং এটি নিজেই একটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা প্রতিশোধের রাজনীতিকে আরও উস্কে দেবে 33। অন্যদিকে, বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে এলে পুরোনো কর্তৃত্ববাদী আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই 20

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের মতো সমস্যাগুলো যদি সমাধান করা না যায়, তবে তা পুনরায় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা নতুন যেকোনো সরকারের জন্য অপরিহার্য হবে 20

তৃতীয়ত, ভূ-রাজনৈতিক চাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশকে তার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী, ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। পূর্ববর্তী হাসিনা সরকারকে ভারতের দৃঢ় সমর্থন দেওয়ার কারণে বর্তমান রাজনৈতিক মহলে ভারত নিয়ে এক ধরনের সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে 20। এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ সামলানো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

সর্বোপরি, রাষ্ট্রের সক্ষমতা পুনর্গঠন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একটি বিশাল কাজ। পূর্ববর্তী শাসনামলে দলীয়করণে দুর্বল হয়ে পড়া প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংস্কার করে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে, দেশে নিরাপত্তা সংকট এবং মাৎস্যন্যায় (mob justice) পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে 41

 

৫.৩ উপসংহার ও সুপারিশমালা

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। এটি একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের জন্য এক অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করেছে। তবে এই প্রতিবেদনটির বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, এই উত্তরণের পথটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বেশ কয়েকটি নিয়ামকের ওপর। ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় এক তরুণ প্রজন্ম, এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করার একটি বিরল সুযোগ 42। তরুণদের সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

তবে, ঝুঁকিগুলোও মারাত্মক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিহিংসার সংস্কৃতি, গভীর অর্থনৈতিক সংকট, এবং একটি দুর্বল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত রাষ্ট্রযন্ত্র—এই বিষয়গুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে লাইনচ্যুত করার ক্ষমতা রাখে। যদি বেসামরিক রাজনৈতিক শক্তিগুলো একটি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তবে সামরিক বাহিনীর মতো অরাজনৈতিক শক্তির প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না 41

এই সংকটময় মুহূর্তে, বাংলাদেশের জন্য একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

১. অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার প্রক্রিয়া: সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রমে সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং তরুণদের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো একটি পক্ষকে বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব নয়।

২. স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন: একটি নির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত সময়সীমার মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি নতুন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

৩. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: অন্তর্বর্তীকালীন এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে অবশ্যই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো আশু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৪. বিচার ও জবাবদিহিতা: পূর্ববর্তী শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির বিচার একটি স্বচ্ছ ও আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। তবে এই প্রক্রিয়াটি যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

৫. গঠনমূলক আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের, বাংলাদেশের এই গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়ায় একটি সহায়ক ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা উচিত।

শেষ পর্যন্ত, বাংলাদেশের ভাগ্য তার জনগণের হাতেই নিহিত। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব দেখিয়েছে যে, এদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। এই গণ-আকাঙ্ক্ষাকে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামোতে রূপান্তরিত করাই হবে আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা।

Works cited

1.     Bangladesh in 2024: A Year of Political Turmoil and Transformation | Vivekananda International Foundation, accessed on September 2, 2025, https://www.vifindia.org/article/2025/january/06/Bangladesh-in-2024-A-Year-of-Political-Turmoil-and-Transformation

2.     Bangladesh in 2024: A Year of Political Turmoil and Transformation | Vivekananda International Foundation, accessed on September 2, 2025, https://www.vifindia.org/article/2025/january/06/bangladesh-in-2024-a-year-of-political-turmoil-and-transformation

3.     দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণা - YouTube, accessed on September 2, 2025, https://www.youtube.com/watch?v=DSwGluqpDUc

4.     2024 Bangladeshi general election - Wikipedia, accessed on September 2, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/2024_Bangladeshi_general_election

5.     Bangladesh's 2024 National Elections: A Pyrrhic Victory - CSIS, accessed on September 2, 2025, https://www.csis.org/analysis/bangladeshs-2024-national-elections-pyrrhic-victory

6.     বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ - উইকিপিডিয়া, accessed on September 2, 2025, https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6_%E0%A6%86%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80_%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%97

7.     Full article: Preference Falsification: Making Sense of Public Opinion Surveys in Autocratising Bangladesh - Taylor & Francis Online, accessed on September 2, 2025, https://www.tandfonline.com/doi/full/10.1080/03068374.2025.2519632

8.     CASE STUDY: BANGLADESH - International IDEA, accessed on September 2, 2025, https://www.idea.int/sites/default/files/2023-11/case-study-bangladesh-gsod-2023-report.pdf

9.     Bangladesh's Revolution Remains Unfinished | United States Institute of Peace, accessed on September 2, 2025, https://www.usip.org/publications/2024/08/bangladeshs-revolution-remains-unfinished

10.  প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোট গ্রহণ আগামীকাল | শিরোনাম | বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), accessed on September 2, 2025, https://www.bssnews.net/bangla/news-flash/136726

11.  উপজেলা পরিষদ নির্বাচন - Bangladesh Election Commission, accessed on September 2, 2025, https://www.ecs.gov.bd/category/upazila-parishad-election

12.  বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্য, accessed on September 2, 2025, https://www.ecs.gov.bd/files/dcUadQikHFFRrIn7Iqtk4xLrenhz3SA8YnyTHhuD.pdf

13.  গেজেট, accessed on September 2, 2025, https://www.dpp.gov.bd/bgpress/bangla/index.php/home/download_file/gazettes/53459_90552.pdf

14.  Bangladesh Country Report 2024 - BTI Transformation Index, accessed on September 2, 2025, https://bti-project.org/en/reports/country-report/BGD

15.  Sheikh Hasina's departure exposes the fractures in Bangladesh's ..., accessed on September 2, 2025, https://www.chathamhouse.org/2024/08/sheikh-hasinas-departure-exposes-fractures-bangladeshs-politics

16.  নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংলাপের আহ্বান - Benar News, accessed on September 2, 2025, https://www.benarnews.org/bengali/news/bd-election-01042024154329.html

17.  Political situation Democratic structures under strain, accessed on September 2, 2025, https://www.bmz.de/en/countries/bangladesh/political-situation-48720

18.  Bangladesh: Crackdown on the political opposition and activists continues ahead of elections - Civicus Monitor, accessed on September 2, 2025, https://monitor.civicus.org/explore/bangladesh-crackdown-on-the-political-opposition-and-activists-continues-ahead-of-elections/

19.  Bangladesh Uprising July-August 2024 | The media's role in ..., accessed on September 2, 2025, https://www.thedailystar.net/opinion/views/news/the-medias-role-bangladesh-20-3773846

20.  Bangladesh: The Dilemmas of a Democratic Transition ..., accessed on September 2, 2025, https://www.crisisgroup.org/asia/south-asia/bangladesh/bangladesh-dilemmas-democratic-transition

21.  Youth Participation in Elections of Bangladesh, accessed on September 2, 2025, https://juojs.sothik.com/index.php/as/article/view/333/252

22.  Explainer: What's Behind Bangladesh's Deadly Protests?, accessed on September 2, 2025, https://www.asiapacific.ca/publication/explainer-whats-behind-bangladeshs-deadly-protests

23.  Politics of Bangladesh - Wikipedia, accessed on September 2, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Politics_of_Bangladesh

24.  গৌরব ও আত্মত্যাগে ৪৭ বছরে বিএনপি | শিরোনাম | বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), accessed on September 2, 2025, https://www.bssnews.net/bangla/news-flash/229979

25.  Country policy and information note: political situation, Bangladesh, December 2024 (accessible) - GOV.UK, accessed on September 2, 2025, https://www.gov.uk/government/publications/bangladesh-country-policy-and-information-notes/country-policy-and-information-note-political-situation-bangladesh-december-2024-accessible

26.  July Revolution (Bangladesh) - Wikipedia, accessed on September 2, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/July_Revolution_(Bangladesh)

27.  The Power of Social Media in Driving Political Change: A Case Study on Bangladesh's Regime Change in 2024 | International Journal of Sociology and Law, accessed on September 2, 2025, https://international.appihi.or.id/index.php/IJSL/article/view/405

28.  2024 Bangladesh quota reform movement - Wikipedia, accessed on September 2, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/2024_Bangladesh_quota_reform_movement

29.  The Future of Bangladesh's Fragile Media Freedom - Centre for Governance Studies, accessed on September 2, 2025, https://cgs-bd.com/article/27295/The-Future-of-Bangladesh%E2%80%99s-Fragile-Media-Freedom

30.  New Media Reforms in Bangladesh Introduced to Replace Hasina-Era Journalism | Al Jazeera Media Institute, accessed on September 2, 2025, https://institute.aljazeera.net/en/ajr/article/3310

31.  2024 Bangladesh constitutional crisis - Wikipedia, accessed on September 2, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/2024_Bangladesh_constitutional_crisis

32.  The Power of the Young: A New Era of Democracy for Bangladesh - Democratic Erosion, accessed on September 2, 2025, https://democratic-erosion.org/2024/12/05/the-power-of-the-young-a-new-era-of-democracy-for-bangladesh/

33.  Bangladesh's revolution is at a crossroads. Open elections are the best way forward. - Atlantic Council, accessed on September 2, 2025, https://www.atlanticcouncil.org/blogs/new-atlanticist/bangladeshs-revolution-is-at-a-crossroads-open-elections-are-the-best-way-forward/

34.  Bangladesh: Mass student unrest raises instability and could be a threat to the government, accessed on September 2, 2025, https://credendo.com/en/knowledge-hub/bangladesh-mass-student-unrest-raises-instability-and-could-be-threat-government

35.  Rapid Research Response (RRR) 2024 - BRAC Institute of ..., accessed on September 2, 2025, https://bigd.bracu.ac.bd/all-projects/rapid-research-response-rrr-2024/

36.  Survey: 4 months after uprising, most Bangladeshis want new elections - VOA, accessed on September 2, 2025, https://www.voanews.com/a/survey-4-months-after-uprising-most-bangladeshis-want-new-elections-/7886497.html

37.  Declining Optimism in Bangladesh: Insights from the 2024 Citizens' Perception Survey, accessed on September 2, 2025, https://asiafoundation.org/declining-optimism-in-bangladesh-insights-from-the-2024-citizens-perception-survey/

38.  Bangladesh Education Crisis Under Interim Government | Education ..., accessed on September 2, 2025, https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/news/education-left-behind-3959881

39.  Political Conflicts and the Impact on Students' Education: A Concerning Risk | Prothom Alo, accessed on September 2, 2025, https://en.prothomalo.com/opinion/editorial/9t27j74hmh

40.  Barriers to youth participation in politics and ways to overcome them ..., accessed on September 2, 2025, https://www.thedailystar.net/supplements/anniversary-supplement-2025/future-forged-youth-the-helm/news/barriers-youth-participation-politics-and-ways-overcome-them-3827001

41.  Bangladesh Is Well-Positioned to Build a New Political Area. Can It Seize the Moment?, accessed on September 2, 2025, https://carnegieendowment.org/emissary/2024/10/bangladesh-hasina-government-politics-what-next?lang=en

42.  Dawn of a new era for Bangladesh's democracy | East Asia Forum, accessed on September 2, 2025, https://eastasiaforum.org/2024/09/30/dawn-of-a-new-era-for-bangladeshs-democracy/

43.  The Future of Democracy in Bangladesh | United States Institute of Peace, accessed on September 2, 2025, https://www.usip.org/publications/2007/03/future-democracy-bangladesh

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url